চোগলখোর জান্নাতে যাবে না

হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।” [মুত্তাফাকুন 'আলাইহি, বুখারী: ৬০৫৬, মুসলিম: ১০৫]

নোট- গোলযোগ সৃষ্টি বা মানুষের মধ্যের পারস্পরিক কলহ-দ্বন্ধ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে একের কথা অন্যকে বলা বা লাগানি-ভাঙ্গানী করাকে চোগলী বলা হয় আর যে ব্যক্তি এমন নিকৃষ্ট কাজ করে থাকে তাকে চোগলখোর বলা হয়।

একজনের কথা-ঝগড়া বিবাদ, মনোমালিন্যের উদ্দেশ্যে অন্যের কাছে লাগানোই ইসলামের পরিভাষায় নামীমা বা চোগলখুরি বলে। সকল ইসলামী চিন্তাবীদ এ সম্পর্কে একমত পোষণ করেন যে, চোগলখুরি সম্পুর্ণ হারাম।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, “সে ব্যক্তির অনুসরণ করো না, যে কথায় কথায় শপথ করে, সে লাঞ্ছিত, যে অসাক্ষাতে নিন্দা করে, যে একজনের কথা অন্যজনের কাছে লাগায়।” [সুরা আলা কালাম ১০ -১১]

রাসুল (সা) বলেছেন, “তোমরা সবচেয়ে অধম লোক দেখতে পাবে সেই ব্যক্তিকে, যে বিভিন্ন জনের কাছে গিয়ে নিজেকে বিভিন্নভাবে বা বিভিন্ন আকারে প্রকাশ করে। আর যে ব্যক্তি পৃথিবীতে দ্বিমুখী আচরণ করবে , কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে দুটি আগুনের জিহ্বা দিবেন।” [বুখারি, মুসলিম, মুয়াত্তা]

দ্বিমুখী আচরণ দ্বারা এখানে দুজনের সাথে দুধরণের কথা বলার প্রতি ইংগিত করা হয়েছে।

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেছেন, দ্বিমুখী লোক বলতে সাধারণত চোগলখোরকে ধরে নেয়া হয়, যে ব্যক্তি একজনকে গিয়ে বলে; অমুক তোমার সম্পর্কে এরুপ কথা বলেছে। সংশ্লিষ্ট দুপক্ষের যে কোন পক্ষ অথবা তৃতীয় কোন পক্ষ যে গোপনীয় বিষয় অপছন্দ করে তা প্রকাশ করা। প্রকাশিত ব্যাপারটি কারো কথা, কাজ বা কোন দোষ ত্রুটি যাই হোক না কেন । অতএব চোগলখুরি হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর কেউ বা তৃতীয় কেউ অপছন্দ করে এমন তথ্য ফাঁস করা। মানুষের যে অবস্থা দৃষ্টিতে পড়ুক না কেন, তা অন্য কারো কাছে প্রকাশ করায় যদি কল্যাণ না হয় এবং এর দ্বারা সমাজকে কোন গুনাহ থেকে রক্ষা করা না যায়, তাহলে তা থেকে বিরত থাকা উচিত।

ইমাম গাযযালী (রহঃ) বলেন, “যার কাছে কেউ চোগলখুরি করে এবং বলে, অমুক তোমার সম্পর্কে এসব কথা বলেছে তখন তার উচিত ছয়টি কাজ করার সংকল্প গ্রহণ করা।

১) তাকে অবিশ্বাস করবে, কেননা সে একজন চোগলখোর ও ফাসিক। সে ব্যক্তি বিশ্বাসযোগ্য নয়।
২) এসব কাজ থেকে তাকে বিরত থাকতে বলবে। কাজটির জন্য কঠোর সমালোচনা করে সদুপদেশ দান করবে।
৩) মন থেকে তাকে ঘৃণা করবে। কেননা সে আল্লাহর কাছে ঘৃণিত। আর আল্লাহর দৃষ্টিতে ঘৃণিত ব্যক্তিকে ঘৃনা করা ওয়াযিব বলে গণ্য।
৪) যে ব্যক্তি সম্পর্কে চোগলখোর খারাপ ধারণা দিয়েছে তার সম্পর্কে তাৎক্ষণিক খারাপ ধারণা করা ঠিক হবে না। কেননা আল্লাহ বলেছেন, ”তোমরা অধিক ধারণা পোষণ থেকে বিরত থাকবে। কেননা কিছু কিছু ধারণায় গুনাহ সংঘটিত হয় ”

৫) তার বর্ণিত তথ্য এতটা গুরুত্বো দেবে না, তার সত্যাসত্য তদন্ত করতে আরম্ভ করবে। কেননা আল্লাহ বলেছেন , “তোমরা কারো দোষ অন্বেষণের ক্ষেত্রে গোয়েন্দাগিরি করার চেষ্টা করবে না।

৬) চোগলখোরকে দেয়া উপদেশ নিজেই যেন লংঘন না করে। চোগলখোর যা বলেছে তা নিয়ে সে যেন অন্যের সাথে সমালোচনা না করে।

হযরত উমার ইবন আব্দুল আযিয (রহঃ) কে এক ব্যক্তি কারো সম্পর্কে একটি খারাপ সংবাদ দিলে তিনি বলেন, তুমি যদি চাও তাহলে তোমার খবরটা নিয়ে অগ্রসর হই। তুমি যদি সত্যই বলে থাকো তাহলে তোমার উপর এ আয়াতের বিধান প্রযোজ্য হবে, “তোমাদের কাছে কোন ফাসিক যদি কোন সংবাদ নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা তা নিয়ে তদন্ত করতে থাকো”। আর যদি তুমি মিথ্যাবাদী হউ, তাহলে তোমার উপর এ আয়াতের বিধান কার্যকর হবে, “যে পশ্চাতে নিন্দা করে, যে একের কথা অপরের কাছে লাগায়।” আর যদি তুমি চাও তো তোমাকে ক্ষমা করে দিই। সে বলল, আমিরুল মুমিনুন আল্লাহ ক্ষমা করুন, আমি এই কাজ আর কখনো করব না বলে প্রতিজ্ঞা করছি।

হযরত হাসান বসরী (রহঃ) বলেন, তোমার কাছে যে ব্যক্তি অন্যের কথা লাগায় জেনে রাখবে, সেও তোমার কথা অন্যের কাছে লাগায়।

এক ব্যক্তি এক বিশিষ্ট আলেমের কাছে এসে অপর এক ব্যক্তির নামে বিভিন্ন দুর্নাম করতে থাকলে তখন এ আলেম বললেন, “তুমি আমার কাছে তিনটি অপরাধ করেছ।
১) আমার এক দ্বীনী ভাইয়ের প্রতি আমার মনে ক্ষোভ ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করেছ।
২) তার কারণে আমার মনকে দুশ্চিন্তায় ভারাক্রান্ত করেছ।
৩) তুমি আমার কাছে বিশ্বস্ততা হারিয়েছ।

এক ব্যক্তি হযরত আলী ইবন আবি তালিব (রাঃ) এর নিকট এসে বলল, অমুক আপনার নামে কুৎসা রটিয়েছে ও গালি দিয়েছে। তিনি বললেন, আমাকে তার কাছে নিয়ে চল। সে তাকে ওই ব্যক্তির কাছে নিয়ে গেল। লোকটি ভেবেছিল হযরত আলী তার কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন। কিন্তু তিনি তাকে গিয়ে বললেন, “হে ভাই ! তুমি যা বলেছ তা যদি সত্য হয়, তাহলে আল্লাহর কাছে আমি ক্ষমা চাই। আর যদি মিথ্যা হয় তাহলে আল্লাহর কাছে তোমার জন্য ক্ষমা চাই”। তখন লোকটি বলল, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন, এমন কাজ আমি আর কখনো করব না।

কোন কোন তাফসীরকার সূরা লাহাবের যে স্থানে আবু লাহাবের স্ত্রীকে “হাম্মালাতাল হাতাব” (জ্বলন্ত কাঠ বহনকারী) বলা হয়েছে, এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন, সে ছিল একজন চোগলখোর। চোগলখুরি স্বভাবটাকে কাষ্ঠ বলা হয়েছে কেননা কাঠ যেমন আগুন জ্বালাতে সাহায্য করে, তেমনি চোগলখোর দুজনের মধ্যে বিবাদের প্ররোচনা দানে অধিক পরিমাণে সাহায্য সহায়তা করে।

চোগলখোরের কার্যক্রম শয়তানী কার্যক্রম অপেক্ষাও অধিক ক্ষতিকর। কেননা, শয়তানী কার্যক্রম সংঘটিত হয় ওয়াস ওয়াসার মাধ্যমে, আর চোগলখুরির কার্যক্রম চলে মান সম্মান হানির দ্বারা।

একবার এক ব্যক্তি দেখতে পেল বাজারে একজন নিজের দাস বিক্রি করছে। বিক্রেতা এভাবে হাকডাক করছে “এ গোলামের একটু চোগলখোরি ব্যতীত আর কোন ত্রুটি নেই”। লোকটি এ দোষটি গুরুত্ব না দিয়ে গোলামটিকে কিনে নিল। গোলামটি তার বাড়িতে অবস্থান করতে লাগল। কিছুদিন পর সে তার মনিবের স্ত্রীকে বলল, আমার মনিব আর একটি বিয়ে করতে চাইছেন, কেননা তিনি আপনার প্রতি আর তেমন অনুরক্ত নেই। আপনি কি এ বিয়ে ঠেকাতে চান আর আপনার স্বামী আপনাকে আগের মতই ভালোবাসুক এটা চান, তাহলে উনি যখন নিদ্রা যাবেন, তখন একটা ছুরি দিয়ে তার কন্ঠনালীর উপরের একটা পশম কেটে নিয়ে নিজের কাছে রাখবেন।

অন্য দিকে মনিবকে সে বলল, আপনার স্ত্রী তলে তলে অন্য একজনের প্রতি আকৃষ্ট এবং তাকে তিনি ভালোবাসেন এবং তার সাথে চক্রান্ত করে তিনি আজ আপনাকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করবেন। আপনি যদি বাঁচতে চান তাহলে আপনি না ঘুমিয়ে কেবল ঘুমের ভান করে শুয়ে থেকে দেখবেন, আপনার স্ত্রী কিভাবে আপনার গলায় ছুরি চালায়। গোলামের কথামত মনিব ঠিক তাই করল, রাতে যেই তার স্ত্রী ছুরি দিয়ে তার গলার পশম কাটতে উদ্যত হল, অমনি মনিব উঠে তার হাত থেকে ছুরি নিয়ে স্ত্রীকে সাথে সাথে হত্যা করল। এরপর স্ত্রীর আত্মীয়রা এসে মনিবকে হত্যা করল। এরপর উভয়পক্ষে তুমুল গন্ডগোল শুরু হল এবং এতে উভয় পক্ষ সর্বস্বান্ত হয়ে গেল। এজন্যই আল্লাহ চোগলখোরকে ফাসিক বলে উল্লেখ করেছেন।

আল্লাহ বলেন, “যদি তোমাদের কাছে কোন ফাসিক সংবাদ নিয়ে আসে, তাহলে তা যাচাই করে নাও। না জেনে যদি কারো অনিষ্ট সাধন কর, তাহলে পরিণামে তোমরা কষ্ট ভোগ করবে।”

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন